রঞ্জন রশ্মি
রঞ্জনরশ্মি বা এক্স-রশ্মি (X-ray) বলতে আলোর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের, মূলত ০.১ থেকে ১০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিসরে এবং ৩x১০১৬ থেকে ৩x১০২০ হার্জের কম্পাংক পরিসরে অবস্থিত ও উচ্চ ভেদনক্ষমতাবিশিষ্ট তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকে বোঝায়।
১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ভিলহেল্ম কনরাড র্যোন্টগেন একটি তড়িৎক্ষরণ নলে 10^-3 মিলিমিটার পারদস্তম্ভ চাপে বায়ুর মধ্যে তড়িৎক্ষরণের পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন যে, নল থেকে কিছু দূরে অবস্থিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড দ্বারা আবৃত পর্দায় প্রতিপ্রভার সৃষ্টি হচ্ছে। পরে তিনি আবিষ্কার করেন যে, তড়িৎক্ষরণ নল থেকে ক্যাথোড( ইলেকট্রন রশ্মি) রশ্মি যখন নলের দেয়ালে পরে তখন এ রশ্মির উৎপত্তি হয়। তিনি এ রশ্মির নাম রাখেন এক্স- রে ; পরবর্তীতে তাঁর সম্মানার্থে এগুলির নাম রঞ্জনরশ্মি রাখা হয়। তিনি মানুষের হাতের হাড়গুলির একটি নাটকীয় আলোকচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে এই রশ্মিগুলির অস্তিত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর এই আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক মহলে ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলে। এর এক বছর পরে ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা ও ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রনের আবিষ্কারের মাধ্যমে পরমাণুর অভ্যন্তরের জগতের গবেষণা সূচিত হয় এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম হয়।
সাধারণত উচ্চ-গতিতে ত্বরিত আধানযুক্ত কণার মন্দনের দ্বারা রঞ্জনরশ্মি উৎপাদন করা হয়। যেমন একটি রঞ্জনরশ্মি নলে ইলেকট্রন কণার রশ্মিগুচ্ছ কোনও ধাতুর (সাধারণত টাংস্টেনের) পাতকে আঘাত করলে কিংবা কোনও কণা ত্বরক যন্ত্রে আবর্তনশীল ইলেকট্রন রশ্মিগুচ্ছের ত্বরণের ফলে রঞ্জনরশ্মি উৎপাদিত হতে পারে। এছাড়া উচ্চমাত্রায় উত্তেজিত পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে স্থানান্তরের ফলে বিচ্ছিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট (যেগুলি পরমাণুর শক্তিস্তরের পার্থক্যের সাথে সংশ্লিষ্ট) রঞ্জনরশ্মি নিঃসৃত হতে পারে। মহাকাশের কিছু বস্তু যেমন কৃষ্ণগহ্বর ও নক্ষত্র (যেমন সূর্য) শক্তিশালী রঞ্জনরশ্মি উৎপাদন করে; এগুলিকে রঞ্জনরশ্মি জ্যোতির্বিজ্ঞান নামক শাস্ত্রে অধ্যয়ন করা হয়। রঞ্জনরশ্মিগুলি আলোর গতিবেগে চলাচল করে।
রঞ্জনরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোকরশ্মির চেয়ে অনেক কম বলে এগুলি অদৃশ্য। তড়িৎ-চুম্বকীয় বর্ণালীর রঞ্জনরশ্মি অঞ্চলটি দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অঞ্চলটি থেকে বহুদূরে অবস্থিত। রঞ্জনরশ্মির চেয়ে হ্রস্ব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (১০-১১ মিটার অপেক্ষা হ্রস্ব তরঙ্গদৈর্ঘ্য) রশ্মিগুলিকে গামা রশ্মি বলা হয়। গামা রশ্মিগুলি পরমাণুকেন্দ্রের (নিউক্লিয়াসের) ভেতর থেকে উৎপাদিত হয়, অন্যদিকে রঞ্জনরশ্মিগুলি পরমাণুকেন্দ্রের বাইরে অবস্থতি প্রক্রিয়াসমূহের কারণে উৎপাদিত হয়। এর বিপরীতে অতিবেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য রঞ্জনরশ্মিগুলির চেয়ে দীর্ঘ হয়। অর্থাৎ তড়িৎ-চুম্বকীয় বর্ণালীতে রঞ্জনরশ্মিগুলি অতিবেগুনি রশ্মি ও গামা রশ্মির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।
কোনও তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হয়, সেটির পদার্থ ভেদ করার ক্ষমতা তত বেশি হয়। তাই রঞ্জনরশ্মিগুলি পদার্থকে ভেদ করে অতিক্রম করতে পারে। এভাবে ভেদ করা রঞ্জনরশ্মিগুলিকে আলোকচিত্রগ্রাহী পর্দা ও অন্যান্য ধরনের শনাক্তকারকের সাহায্যে লিপিবদ্ধ করা যায়। মানবদেহের মধ্য দিয়ে রঞ্জনরশ্মি অতিক্রম করিয়ে সেগুলির আলোকচিত্র গ্রহণ করে সেটিকে দেহের বিভিন্ন রোগনির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়; তাই রঞ্জনরশ্মি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। হাড়ের ভাঙন, দাঁতের গর্ত, কর্কটরোগ (ক্যানসার), দেহাভ্যন্তরে বহিরাগত বস্তু, ইত্যাদি শনাক্ত করতে এগুলি বহুল ব্যবহৃত হয়। তবে মাত্রাতিরিক্ত রঞ্জনরশ্মি মানবদেহে আপতিত হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। জীবন্ত দেহকলার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় রঞ্জনরশ্মিগুলি বংশাণু (জিন), বংশসূত্র (ক্রোমোজোম) ও দেহকোষের অন্যান্য উপাদানের প্রাণ-রাসায়নিক ক্ষতিসাধন করতে পারে। রঞ্জনরশ্মির প্রকৃতি ও স্থায়িত্বকালের উপর নির্ভর করে বিকিরণের জৈব প্রভাব জটিল হতে পারে, এবং বিকিরণজনিত জখমের উপরে গবেষণা চলমান আছে। আবার রঞ্জনরশ্মি বিকিরণকে কাজে লাগিয়ে দুষ্ট অর্বুদ বা টিউমারের বৃদ্ধি রুখতে রঞ্জনরশ্মি বিকিরণ চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এছাড়া ধাতব বস্তু শনাক্ত করতেও রঞ্জনরশ্মি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শিল্পখাতে কাঠামো বিশ্লেষণে ও এগুলির মধ্যে ত্রুটি শনাক্ত করতে রঞ্জনরশ্মির প্রয়োগ আছে।
বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]রঞ্জনরশ্মি ও সাধারণ আলোকরশ্মির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল এদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে। সাধারণ আলোকরশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৭x১০−৭ মিটার থেকে ৪x১০−৭ মিটারের কাছাকাছি। রঞ্জন রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ১০−৮ মিটার থেকে ১০−১১ মিটারের কাছাকাছি। সাধারণ আলো দৃশ্যমান এবং বিভিন্ন রঙে বিভক্ত হয়। কিন্তু রঞ্জন রশ্মি দৃশ্যমান নয়। রঞ্জন রশ্মি উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন। রঞ্জন রশ্মির আয়ন সৃষ্টিকারী বিকিরণ গ্যাস বা বায়বীয় পদার্থের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় বায়বীয় পদার্থটিকে আয়নিত করে, কিন্তু সাধারণ আলোকরশ্মি এটি করতে পারে না।
প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]- কোমল রঞ্জন রশ্মি (Soft X-ray): রঞ্জন রশ্মি যন্ত্রে কম বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করে যে রঞ্জন রশ্মি পাওয়া যায় অর্থ্যাৎ যে রঞ্জন রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশি, ফলে ভেদন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম, তাকে কোমল রঞ্জন রশ্মি বলে।
- কঠিন রঞ্জন রশ্মি (Hard X-ray): রঞ্জন রশ্মি যন্ত্রে বেশি বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করে যে রঞ্জন রশ্মি পাওয়া যায় অর্থাৎ যে রঞ্জন রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম, ফলে ভেদন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি, তাকে কঠিন রঞ্জন রশ্মি বলে।
একক
[সম্পাদনা]রঞ্জনরশ্মির একক হল রন্টজেন। এক রন্টজেন বলতে সেই পরিমাণ বিকিরণ বুঝায় যা স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় এক মিলিমিটার বায়ুতে এক স্থির বৈদ্যুতিক আধানের সমান আধান উৎপন্ন করতে পারে।
আবিষ্কার
[সম্পাদনা]জার্মান বিজ্ঞানী র্যোন্টগেন (রন্টজেন) তড়িৎক্ষরণ নলে (discharge tube) ১০−৩ মিলিমিটার পারদ চাপে বায়ুর মধ্যে তড়িৎক্ষরণের পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে নল থেকে কিছু দূরে অবস্থিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড আবৃত পর্দায় প্রতিপ্রভার সৃষ্টি হচ্ছে। পরে তিনি আবিষ্কার করেন যে, তড়িৎক্ষরণ নল থেকে ক্যাথোড রশ্মি যখন নলের দেয়ালে পড়ে তখন এই রশ্মির উৎপত্তি হয়। তিনি এই রশ্মির নাম রাখেন এক্স রশ্মি, যা বাংলায় রঞ্জনরশ্মি নামে পরিচিত।
উৎপাদন
[সম্পাদনা]পরিবাহী সূত্র বা ফিলামেন্ট F-এর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎপ্রবাহ ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বা ক্যাথোড C-কে উত্তপ্ত করলে ইলেকট্রন তাপীয় নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় একটি রঞ্জনরশ্মি নলের প্রয়োজনীয় অংশ ক্যাথোড থেকে মুক্ত হয়ে আসে। তারপর একটি অতি উচ্চ বিভব প্রভেদ V-এর দ্বারা ইলেকট্রনগুলি ত্বরিত হয় ও ধনাত্মক তড়িৎদ্বার তথা আ্যনোডরূপী লক্ষ্যবস্তু T-তে আঘাত করে। ফলে রঞ্জনরশ্মি উৎপন্ন হয়।
ধর্ম
[সম্পাদনা]- রঞ্জনরশ্মি সরলরেখায় গমন করে।
- রঞ্জনরশ্মি অত্যধিক ভেদনক্ষমতাসম্পন্ন।
- রঞ্জনরশ্মি একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এটি বিচ্যুত হয় না।
- রঞ্জনরশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুব হ্রস্ব, কম্পাঙ্ক খুব উচ্চ।
- সাধারণ আলোর ন্যায় রঞ্জনরশ্মির প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ও সমাবর্তন হয়ে থাকে।
- আলোকচিত্রগ্রাহী পাতের (ফটোগ্রাফিক প্লেট) উপর এর প্রতিক্রিয়া আছে।
- রঞ্জনরশ্মির আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া আছে।
- জিঙ্ক সালফাইড, বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড, প্রভৃতি পদার্থে এ রশ্মি প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে।
- রঞ্জনরশ্মি গ্যাসীয় পদার্থে আয়ন সৃষ্টিকারী বিকিরণ।
- রঞ্জনরশ্মি আধান নিরপেক্ষ।
- রঞ্জনরশ্মি অদৃশ্য। সাধারণ আলোকরশ্মি অক্ষিপটে পড়লে দৃষ্টির অনুভূতি জন্মায়, কিন্তু রঞ্জনরশ্মির ক্ষেত্রে এমন হয় না।
- রঞ্জনরশ্মির তীব্রতা ব্যস্তানুপাতিক সূত্র মেনে চলে।
- রঞ্জনরশ্মি জীবন্ত কোষকে ধ্বংস করতে পারে।
- রঞ্জনরশ্মি প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে।
- রঞ্জনরশ্মি আলোর বেগে অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩×১০৮ মিটার (৩ লক্ষ কিলোমিটার) বেগে গমন করে।
ব্যবহার
[সম্পাদনা]চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার
[সম্পাদনা]- স্থানচ্যুত হাড়, হাড়ে দাগ বা ফাটল, ভেঙ্গে যাওয়া হাড়, শরীরের ভিতরের কোন বস্তুর বা ফুসফুসের ক্ষত, দাঁতের ক্যারিস ইত্যাদির অবস্থান নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
- সিটি স্ক্যান হল কম্পিউটারের সাহায্যে রঞ্জন রশ্মি দ্বারা গৃহীত চিত্র সমন্বয় করে ত্রিমাত্রিক বা প্রস্থছেদ চিত্র বানানোর ব্যবস্থা।
- ক্যান্সারের চিকিৎসায় রঞ্জন রশ্মি বিকিরণ ব্যবহৃত হয়।
- পরিপাক(Digestive) নালী দিয়ে খাদ্যবস্তুর গমন পথ অনুসরণ, আলসার নির্ণয় ইত্যাদির জন্য ব্যবহার করা হয়।
শিল্পখাতে ব্যবহার
[সম্পাদনা]- ধাতব ঢালাইয়ের দোষ ত্রুটিপূর্ণ ঢালাই, ধাতব পাতের গর্ত, ইত্যাদি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
- কেলাস গঠন পরীক্ষায় রঞ্জনরশ্মি ব্যবহৃত হয় এবং মণিকারেরা এর সাহায্যে আসল ও নকল গহনা চিহ্নিত করতে পারেন।
- টফি, লজেন্স, সিগারেট ইত্যাদির মান বজায় আছে কিনা বা টফি ও লজেন্সে ক্ষতিকর কোন কিছু মিশ্রিত হয়েছে কি না, তা জানার জন্য ব্যবহৃত হয়।
গোয়েন্দা বিভাগে ব্যবহার
[সম্পাদনা]- কাঠের বাক্স বা চামড়ার থলিতে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখলে তা খুঁজে বের করতে ব্যবহার করা হয়।
- শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা চোরাচালানের দ্রব্যাদি খুঁজে বের করতে ব্যবহার করেন।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Kevles, Bettyann Holtzmann (১৯৯৬)। Naked to the Bone Medical Imaging in the Twentieth Century। Camden, NJ: Rutgers University Press। পৃষ্ঠা 19–22। আইএসবিএন 0813523583।
- ↑ Sample, Sharron (2007-03-27)। "X-rays"। The electromagnetic spectrum। NASA। সংগ্রহের তারিখ 2007-12-03। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য)
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |