What do you think?
Rate this book
328 pages, Hardcover
First published January 1, 2012
নানা বই শুরু করলেও শেষ করতে পারি না। গ�� কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি বই শুরু করেও মাঝপথে বা আদোপথে বাদ দিয়েছি। এক বই থেকে আরেক বই-এ আগ্রহ চলে গ্যাছে। আগে এটা নিয়ে কষ্ট লাগতো এখন পাত্তা দেই না। এটা বই-পড়া অভিজ্ঞতার অংশ-ই ধরে নিছি। যা গিয়া যা থাকে। বোরড হওয়া যাইবো না। বছর দুই আগে একবার “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” পড়া শুরু করছিলাম। খুলনা থেকে ঢাকা আসার পথে গোপালগঞ্জ-এ আসতে মনে পড়লো ব্যাগে বইটা আছে, পড়া শুরু করলাম। যদ্দূর মনে পরে অল্প কয়েক পৃষ্ঠার বেশি আগাইতে পারি নাই। গাড়ির ঝাঁকুনি, ভ্রমণ ক্লান্তি এইসব কারণ হইতে পারে। আবার প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা বইটার তেমন মজারও না এর পরের অংশের তুলনায়।
কিছুদিন আগে আবার পড়া শুরু করলাম। একবারে পুরোটা পড়ার তাকত নাই। একদিনে দশ পৃষ্ঠা করে টার্গেট নিয়ে আগানোর চেষ্টা করলাম। পরে দেখলাম এই বই নিজেই আমাকে টেনে রাখছে। কারণ হতে পারে শেখ মুজিবের গল্প বলার ধরণ, হতে পারে যে গল্প তিনি করেছেন সেগুলোর অভিনবত্ব, হয়তো দুটোই। ভারত ভাগ, বাংলা ভাগ, সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গা, পাকিস্তান প্রজেক্টের মুখ থুবরে পড়া, ভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগের ফরমিডেবল বিরোধীদল আওয়ামীলিগের যাত্রা, পাকিস্তানের পশ্চিমমুখিতা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, ফজলুল হক। ভাসা ভাসা জানা ছিলো এসবের অনেক কিছুই কিন্তু এবার-ই প্রথম এই বিস্তারিত সময়ের সামনের সারিতে বসে দেখা এবং কখনো পার্শ্ব কখনো মূল চরিত্রে ভূমিকা রাখা কারো অভিভাষণ পড়লাম। প্রথমত এক কথায় অনন্য। আমি এর আগে কারো লেখা পড়ে বা কারো সম্পর্কে জেনে এতোটা অভিভূত হইনি। যদিও আমার পড়া এবং জানা দুটোই কম, তারপরও।
ব্রিটিশ সরকারের সেরেস্তাদার বাবা-র প্রভাব ছিল মুসলিম লীগে জয়েন করার এবং সেখানে কাজ করার ক্ষেত্রে। এ প্রভাব অবশ্য বেশ সাটল ছিলো। আমার মনে হয়েছে অথরিটি ফিগারের প্রভাব শেখ মুজিবরের উপর সবসময়ই ছিলো। বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সেটা লক্ষণীয়। উদাহরনস্বরূপ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও “আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামকরণ এবং নামমাত্র দলের সাথে যুক্তফ্রন্টে যোগদান। গোপালগঞ্জে মুসলিমলীগের সমাবেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসলে, শেখ মুজিবর “শহীদ সাহেব” করে সম্বোধন করেছেন বইয়ে, সেখানেই প্রথম দেখা হয় পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতার সাথে প্রান্ত-কৈশরে থাকা সমাবেশ স্বেচ্ছাসেবক মুজিবরের সাথে, যিনি পরবর্তিতে নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ আন্দোলনের। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবরের রাজনৈতিক জীবনে প্রবল প্রভাব বিস্তারি ছিলেন। মুজিবুর ভালোবাসতেন শহীদ সাহেবকে, ভক্তি করতেন তার বিচার-বিবেচনাবোধ। উদারতা, জনগণের প্রতি ভালবাসা, রাজনৈতিক ত্যাগ স্বীকার শহীদ সাহেবের এসব বৈশিষ্ট্য প্রশংসার চোখে দেখতেন মুজিবুর যা নিজেও ধারণ করার চেষ্টা করতেন। যুক্তফ্রন্টের কনিষ্ঠতম মন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের সাথে দেখা করতে গেলে শেখ মুজিবুরকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “লোকে বলে, আপনি কমিউনিস্ট, একথা সত্য কি না?” শেখ মুজিবুর উত্তর দেন, “যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট। আর যদি তিনি অন্য কিছু হন তবে আমিও তাই।” কমিউনিজমকে সন্দেহের চোখে দেখতেন শেখ মুজিবুর। সে সন্দেহ যতখানি না ভাবাদর্শগত তারচেয়ে বেশী প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে। নিজেকে দেখেছেন একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবে। অর্থনৈতিক সাম্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি ছিল সে ভাবনায়। যেমন আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একবার বলেন
“আওয়ামীলীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনদিন কোন রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। ”যদিও এই ভাবনার ধারণ শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রাখতেন কিনা বোঝা যায় নি। বরং শুরুতে তাকে পাকিস্তান আন্দোলনের জন্যই বেশি অন্তপ্রাণ দেখা যায়। এবং আমরা-ওরা চিন্তাসূত্রের প্রভাব দেখা যায়। দিল্লিতে মুসলিমলীগের কনভেনশানে গিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর(সাকার বাবা) সৌজন্যে তাজমহল ঘুরতে গিয়ে মাগরিবের আজান শুনে লেখকের আশংকা, “পাকিস্তান হওয়ার পর (ভারতের তাজমহলে) আজান হয় কিনা জানি না।” সে বার ফকাসহ বাকিদের নিয়ে দিল্লির ফতেপুর সিক্রি ও সেকেন্দ্রা, আগ্রার দুর্গ দেখে মুসলিম শাসন নিয়ে নস্টালজিয়ায় বিমগ্ন হন শেখ মুজিবুর। অথচ ৬-৭ বছর পরেই ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের ডেলিগেটদের একজন হয়ে নতুন চীনের আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে গিয়ে “ফরবিডেন সিটি”, সম্রাটরা পূর্বে তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে এখানে থাকতেন যেখানে অন্যদের প্রবেশ নিষেধ ছিল, ঘুরে ভাবলেন, “ভারতে লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি এবং আগ্রাকেল্লাও আমি দেখেছি। ফরবিডেন সিটিকে এদের চেয়েও বড় মনে হল।…………. দেখলাম ও ভাবলাম, রাজ-রাজড়ার কাণ্ড সব দেশেই একই রকম ছিল। জনগণের টাকা তাদের আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় করতেন, কোন বাধা ছিল না।” শান্তি সম্মেলনের এই ভ্রমণ শেখ মুজিবুরের স্বাধীনতা চেতনা গড���ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। সমাজতন্ত্রের প্রতি সুদৃষ্টি তৈরীতেও প্রভাব ছিলো মনে করি। এখানেই প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর পূর্ব-পাকিস্তানের হয়ে বক্তৃতা করেন বাংলা ভাষায়! বেশ গর্বিত ছিলেন এ নিয়ে।
গোপালগঞ্জে ও এর আশেপাশের এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন শুরু থেকেই। আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে থাকলো। যেখানেই যেতেন পরিচিত মানুষ ছিল। এতো নাম ঘটনাক্রমসহ মনে রেখেছেন কী করে! রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনে হয় এটা বিশেষ গুণ। প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন গোপালগঞ্জ থেকে মুসলিম লীগের বিপরীতে ১৯৫৪’তে(যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন)। সেখানে তার বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিলো “... ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে”, পীর মাওলানারা ফতোয়া দিলেন। যদিও ধোপে টেকেনি। ঐদিনে দশ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন। জনগন টাকা দিয়ে, টাকা তুলে মুসলিম লীগের বিত্তশালী প্রার্থীর বিপরীতে তাঁকে জয়ী করেছে। লিখেছেন, “.... গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখতে চায়। আমি ইলেকশনে নামার পূর্বে জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালবাসে। আমার মনে একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময়ে হয়েছিল।”
রাজনৈতিক জীবন বিস্তৃত করতে গিয়ে পারিবারিক জীবনে সময় দিতে পারেন নি। এ নিয়ে বরাবর-ই খারাপ লাগা ছিল জাতির পিতা-র। বইয়ের ব্যাক-কাভার থেকে,
“ একদিন সকালে আমি ও রেণু(স্ত্রী) বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্ত আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল।”শেখ মুজিবুর কামালের একমাস বয়সে জেলে যান তাই কামাল তাকে চিনতে পারে নি। বাবাকে খুব কম সময়ের জন্যেই কাছে পেয়েছিলেন কামালেরা। মায়ের কাছে বড় হয়েছেন। স্ত্রীর এই অসামান্য ত্যাগ এবং অবদানের কথা বারবার স্মরণ করতে দেখেছি লেখককে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে গভর্নর শাসন চালু হলে আবারও গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবর রহমান, চতুর্থবারের মত, সেখানেই এ বই-এর শেষ। এ সিরিজের পরবর্তি বই “কারাগারের রোজনামচা” পড়ার আগ্রহ এখন তাই তুঙ্গে।
পাকিস্তান স্বাধীন করেও মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেননি বলে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, বাঙ্গালি-জাতি চেতনাবোধ নির্মাণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তখন মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন আফসোস সে লড়াই এখনও প্রাসঙ্গিক অথচ সংগ্রাম সমান জাগরূক নয়। বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুসলিম লীগের অপশাসনের চিত্র তুলে ধরে লেখা কয়কটি লাইন উল্লেখ করছি, এ ছবি আমাদের বেশ পরিচিত।
“মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পরে। মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাদের উপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুণ্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনদিন সফল হয় নাই, আর হতে পারে না- এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করেন নাই।”
বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখ”। সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।” আমার সহধর্মিনী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, “লিখতে যে পারিনা; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়!" আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”
অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।
“Now when I think of him in jail, I remember what he had told me then. Even in 20 years, he never veered from what he said that day. Indeed, from that day, every day of my life I was blessed with his love. In all these years, no one could take me away from him and I didn’t let anyone deprive me of his love.”