যাবুর
ইসলাম |
---|
বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
ইসলাম ধর্মমতে জাবুর (আরবি: الزبور, প্রতিবর্ণীকৃত: az-zabūr) হলো দাউদ (আ.) (আরবি: داوود) এর উপর সুমহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ একটি আসমানী কিতাব। তাওরাত (তোরাহ) ও ইনজিলের (সুসমাচার) মতো অন্যান্য গ্রন্থের পাশাপাশি কুরআনের পূর্বে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ আসমানী কিতাবগুলোর মধ্যে এটি একটি। মুসলিম হাদিস মতে কুরআনে উল্লিখিত জাবুর হচ্ছে দাউদের সামসঙ্গীত।[১] এটি মোট নাজিলকৃত ১০৪ টি আসমানি কিতাবের মধ্যে বড় ৪ খানা কিতাবের একটি। যেটি খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মেও মর্যাদাসম্পন্ন কিতাব।
প্রাক-ইসলামি আরবি কবিতায় প্রাক-ইসলামি আরবের খ্রিস্টান ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীরা মাজমুর নামক পাঠ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল, অন্য প্রসঙ্গে যাকে তালপাতার নথি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[২] কেউ কেউ এটিকে সামসঙ্গীতের খণ্ড উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছেন।[৩]
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক খ্রিস্টান দ্বারা হিব্রু বাইবেলে ডেভিডের সামসঙ্গীতকে বোঝানোর জন্য মাজমুর (হিন্দুস্তানি: مزمور (নাস্তালিক), ज़बूर (দেবনাগরী)) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]আরবি শব্দ জাবুর অর্থ গ্রন্থ, শিলালিপি
লেখ্যা"লেখ্য"।[৪] প্রাথমিক সূত্রে এটি তালপাতায় প্রাচীণ দক্ষিণ আরবীয় লেখ্যকে উল্লেখ করতে পারে।[২]
অধিকাংশ পশ্চিমা বিদ্যাবত্তা জাবুর শব্দটি ‘সল্টার’ তথা সামখণ্ড অর্থে দেখেন যেহেতু তাঁরা মনে করেন যে সামসঙ্গীত অর্থে ব্যবহৃত হিব্রু শব্দ মিজমার (হিব্রু ভাষায়: מִזְמוֹר) বা এর আরামীয় সমতুল্য মাজমুরা (সিরীয়: ܡܙܡܘܪܐ)-এর সঙ্গে আরবি যাবুর শব্দটির সংমিশ্রণ হয়ে গেছে।[২]
উক্ত অর্থে জাবুর শিরোনামের একটি বিকল্প স্বল্পস্বীকৃত উৎস হলো যে এটি হিব্রু জিমরাহ (হিব্রু ভাষায়: זִמְרָה), যার অর্থ "গান, সঙ্গীত", বা সিপ্পুর (হিব্রু ভাষায়: סִפּוּר), যার অর্থ "গল্প", শব্দের একটি অপভ্রংশ।[৫]
বর্ণনা
[সম্পাদনা]যাবুর হযরত দাউদ (আ.) এর উপরে নাজিল হয়েছিল। এটি হিব্রু ভাষায় লিখিত। হযরত দাউদ -এর পুত্র হযরত সুলায়মান-এর রাজত্ব কালেও এটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত। যা হযরত মুসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ তাওরাতের পরের আসমানী দ্বিতীয় বড় কিতাব।
কুরআনে উল্লেখ
[সম্পাদনা]কুরআনে তিনবার যাবুরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে এটি দাউদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যাবুরে লেখা রয়েছে "আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাহ্গণই পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে"।[৬][৭]
আমি তোমার কাছে ওহি পাঠিয়েছি যেমন নুহ ও তার আগের নবিগণের নিকট ওহি পাঠিয়েছিলাম, আর ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধর আর ইসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সুলায়মানের নিকটও ওহি পাঠিয়েছিলাম আর আমি দাউদকে যাবুর প্রদান করেছিলাম।
— কুরআন ৪:৬৩[৮], তাইসিরুল
আসমান আর জমিনে যারা আছে তোমার প্রতিপালক তাদেরকে ভাল করেই জানেন। আমি নবিগণের কতককে অন্যদের উপর মর্যাদা দান করেছি আর দাউদকে দিয়েছি জাবুর।
— কুরআন ১৭:৫৫[৯], তাইসিরুল
(এর আগে মুসাকে) বাণী দেয়ার পর আমি জাবুরে লিখে দিয়েছিলাম যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাহ্গণই পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে।
— কুরআন ২১:১০৫[৭], তাইসিরুল
সামসঙ্গীতের সঙ্গে সম্পর্ক
[সম্পাদনা]কুরআনে জাবুর বলতে সামসঙ্গীতকে বোঝানো হয়েছে।[১০] কুরআনের ২১:১০৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে যাবুরে একটি উদ্ধৃতি আছে "আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাহ্গণই পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে"। আয়াতটি সামসঙ্গীত অধ্যায় ৩৭-এর ২৯তম পদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে বলা হয়েছে "সত্ লোকরা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত রাজ্য পাবে। সেখানে তারা চিরদিন বাস করবে।"[১১][১০][৬][১২]
আহরেন্স (১৯৩০) এই মতকে সমর্থন করেন যে আল-আম্বিয়ার ১০৫ নং আয়াতটি যাবুর থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।[১৩] তিনি বলেন যে কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, "স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর আমি যাবুরে লিখে দিয়েছি যে আমার সৎ বান্দারা পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে।" তাঁর সিদ্ধান্ত হলো যে এই আয়াতটি হিব্রু বাইবেল এবং আরও স্পষ্টভাবে দায়ূদের সামসঙ্গীত ৩৭-এর সঙ্গে কুরআনের একটি ঘনিষ্ঠ ও বিরল ভাষাগত সাদৃশ্য প্রকাশ করে।
হাদিসে
[সম্পাদনা]ইমাম বুখারির মতে সহীহ একটি হাদিসে বলা হয়েছে:
আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দাউদ (আ.)-এর জন্য কুরআন (জাবুর) তিলাওয়াত সহজ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর পশুযানে গদি বাঁধার আদেশ করতেন, তখন তার উপর গদি বাঁধা হতো। অতঃপর তাঁর পশুযানের ওপর গদি বাঁধার পূর্বেই তিনি জাবুর তিলাওয়াত করে শেষ করে ফেলতেন। তিনি নিজ হাতে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন।[১৪]
— ইমাম বুখারি, ৩৪১৭
কেটুভিম
[সম্পাদনা]খ্রিস্টান আত্মপক্ষসমর্থক কার্ল গটলিপ ফান্ডারের যাবুর সম্পর্কে কুরআনের উল্লেখটি আসলে হিব্রু ধর্মগ্রন্থের তৃতীয় ভাগকে নির্দেশ করে, যেটি লেখ্য বা কেটুভিম নামে পরিচিত, এটি ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থসমূহের একটি বিস্তৃত শ্রেণী যেখানে সামসঙ্গীত এবং হিব্রু সাহিত্য ও কবিতার অন্যান্য সংগ্রহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[১৫]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Dariusz Kolodziejczyk (২০১১)। The Crimean Khanate and Poland-Lithuania: International Diplomacy on the European Periphery (15th-18th Century). A Study of Peace Treaties Followed by Annotated Documents। BRILL। পৃষ্ঠা 397। আইএসবিএন 978-90-04-19190-7।
- ↑ ক খ গ Horovitz, Josef (১৯৯৯)। "mazmour"। Bearman, P. J.। Encyclopedia of Islam। XI (2nd সংস্করণ)। Leiden: Brill। পৃষ্ঠা 372–373।
- ↑ Shahîd, Irfan (১৯৮৯)। Byzantium and the Arabs in the Fifth Century। Dumbarton Oaks। পৃষ্ঠা 520। আইএসবিএন 9780884021520।
- ↑ Lane, Edward William (১৮৬৮–১৮৯৩)। An Arabic-English lexicon। London: Williams and Norgate। পৃষ্ঠা 1210–1211। ওসিএলসি 248351096।
- ↑ Jeffery, Arthur (১৯৩৮)। The Foreign Vocabulary of the Qur'ān। Baroda, India: The Oriental Institute। পৃষ্ঠা 148–149। ওসিএলসি 28304469।
- ↑ ক খ "সামসঙ্গীত Psalms 37: বাংলা বাইবেল - Bengali Bible - পুরানো ইচ্ছাপত্র - Old Testament"। www.wordproject.org।
- ↑ ক খ "(২১) আল-আম্বিয়া | (21) Al-Anbiya | سورة الأنبياء-অনুবাদ/তাফসীর"। www.hadithbd.com।
- ↑ "(৪) আন-নিসা | (4) An-Nisa | سورة النساء-অনুবাদ/তাফসীর"। www.hadithbd.com।
- ↑ "(১৭) আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | (17) Al-Isra | سورة الإسراء-অনুবাদ/তাফসীর"। www.hadithbd.com।
- ↑ ক খ Psalm (Online)। The Oxford Dictionary of Islam। Oxford Reference Online - Oxford University Press। ২০০৩। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0।
Arabic zabur. In the Quran the Psalms of David are said to be revelation sent to David, who is considered a prophet (4:163; 17:55; 21:105). God is considered the author of the psalms. Surah 21:105 is a direct counterpart of the biblical Psalm 37:29.
- ↑ "Psalms 37:29"। www.sefaria.org।
- ↑ গীত ৩৭:২৯
- ↑ K. Ahrens, Christliches im Qoran, in ZDMG , lxxxiv (1930), 29
- ↑ "সহিহ বুখারি (তাওহিদ পাবলিকেশন)| হাদিস:৩৪১৭ | Sahih al-Bukhari, Hadith No. 3417"। www.hadithbd.com।
- ↑ C. G. Pfander, The Balance of Truth, pg. 51